Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ ।


প্রকাশন তারিখ : 2021-12-15

 

বাজারে প্রতিযোগিতা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা

 সৈয়দ মুহাইমিন উল ইসলাম মাহী 

 ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম 

 

অর্থনীতি

সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা বলতে একটি মুক্তবাজার ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিযোগিতামূলক অনুশীলন, দ্রব্যমূল্য, গুণমান এবং গ্রাহকসেবার ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। প্রতিযোগিতাকে বাজারের চালিকাশক্তি বলা হয়। একটি সুবিন্যস্ত, ন্যায্য এবং মুক্তবাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা বেসরকারি খাতের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। প্রতিযোগিতা বাজারে বিনিয়োগের আস্থা সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে; এতে বিনিয়োগে দেশজ প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং এটি দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। প্রতিযোগিতা বড় উদ্যোক্তার পাশাপাশি মাঝারি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এবং SMEs দের বাজারমুখী করা ও সবার জন্য সমতাভিত্তিক সুযোগ সৃষ্টি করে। মূলত উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং প্রতিযোগিতার কর্মসূচি ও পদ্ধতিগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত-যেখানে একে পরস্পর থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থনীতির আলোচনায় প্রতিযোগিতা সম্পর্কে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। আধুনিক অর্থনীতির জনক Adam Smith 1776 সালে মুক্ত বাণিজ্য ও জিডিপি’র যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, সেখানে তিনি বাজার অর্থনীতির মৌলিক পরিগ্রহ হিসাবে মুক্ত প্রতিযোগিতার কথা বলেছেন। Adam Smith তার বই An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মনোপলি ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অপরদিকে Alfred Marshall উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বাস্তবধর্মী প্রতিযোগিতার কথা বলেছেন, যা ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লবে প্রভাব ফেলেছিল (Principles of Economics-1890)। আশির দশকের প্রথম দিকে ‘Contestable Markets Theory’ প্রকাশিত হওয়ার পর (William J. Baumol, John C. Panzar, & Robert D. Willig; Contestable Markets and the Theory of Industry Structure-1982) মুক্তবাজার অর্র্থনীতিতে প্রতিযোগিতার একটি কাঠামোগত ধারণা তৈরি হয়, যা ছিল একটি পূর্ণ আবিষ্কার। এখান থেকে প্রতিযোগিতার গতিময় প্রভাব ও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এর সম্পর্কের বিষয়ে একটি বাস্তব ধারণা পাওয়া যায়। যাই হোক, অর্থনীতিবিদরা প্রতিযোগিতা বিষয়টিকে Trial and Error প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে প্রতিযোগিতা বাজারের জন্য সবসময় নির্ভুল নাও হতে পারে।

অপরদিকে Neoclassical অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলোর মধ্যে Competition Conceptটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিযোগিতা ভোক্তাকে পণ্য বাছাইয়ের পরিসরটি বাড়িয়ে দিয়ে কম মূল্যে ক্রয়ে সহযোগিতা করে। এতে করে বিক্রয় বৃদ্ধিতে উৎপাদক তার উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন মূল্য সংকোচন ও অপচয় রোধে একটি শক্ত অবস্থান পায়। একইসঙ্গে উৎপাদক ডাইনামিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের বৈচিত্র্য ঘটাতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশ কিছু কোম্পানির ওপর ১৯৯৬ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফলে উৎপাদনজনিত প্রবৃদ্ধির সূচক অনেক বেড়ে যায় (Nickell, Stephen J, 1996. ‘Competition and Corporate Performance,’ Journal of Political Economy, University of Chicago)। তদ্রুপভাবে একই রকম গবেষণায় ১৯৯৯ সালে Mark Dutz এবং Aydin Hayri দেখিয়েছেন, প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একটি ধনাত্মক প্রভাব বজায় রাখে (Does More Intense Competition Lead to Higher Growth? Centre for Economic Policy Research, London)। অন্যদিকে ১৯৯৮ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের James Tybout এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, তাইওয়ানে ১৯৯৮ সালে প্রতিযোগিতাজনিত প্রভাবে সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, অদক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। একই ধারা বজায় রেখে বিশ বছর পর সাম্প্রতিক সময়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেও ২০২০ সালের ঈেও সূচকে তাইওয়ানের বর্তমান অবস্থান এখন ১৩তম।

বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের মান উন্নয়ন, বিপণন ও উৎপাদন কাঠামোতে অধিক মনোনিবেশ করে। উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উৎপাদন খরচ কমানোর কৌশল উদ্ভাবন করে। বাজার সংকোচিত হওয়ার আশঙ্কা মাথায় রেখে একই রকম পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চমানসম্পন্ন পণ্য, উৎকৃষ্ট সেবা ও তুলনামূলক কম মূল্যে পণ্য প্রাপ্তির সুযোগ করে দেয়। প্রতিযোগিতা পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

সম্প্রতি ব্যাংকিং সেবার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী নানা সেবা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আসলে বাজারে প্রতিযোগিতাই নতুন উদ্ভাবন সচল রাখে। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে সাধারণ মানুষের পণ্য ও সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ এবং পণ্যে সর্বোচ্চ উপযোগ পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনে উদ্ভাবন আনয়নের জন্য বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের MRTP (Control & Prevention) Ordinance (Ordinance to provide for measures against undue concentration of economic power, growth of unreasonable monopoly power and unreasonably restrictive trade practices) রহিত করে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন করা হয়।

ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ নিয়ন্ত্রণ, মনোপলি, ওলিগোপলি অবস্থা, কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার রোধ, জোটবদ্ধতা ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে এ আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনের ৫ ধারা মোতাবেক সরকার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করেছে।

আশার কথা, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বাজারে মনিটরিংয়ের কাজটি করে থাকে; পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বাজারেও অদৃশ্য এমন অনেক বিষয় থাকে, যা প্রয়োগ বা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে জনসম্পদ, ভৌত সুবিধাদি, আস্থাসূচক ডেটা ও উৎপাদন খরচ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য, বাজার পরিধি, ভোক্তার আচরণ ইত্যাদি বিষয়ক তথ্য ও সম্পদের অভাবে প্রতিযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের সুফল পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। The Organisation for Economic Co-operation and Development (OECD)- বাজার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে অধিক গুরুত্বারোপ করেছে।

অপ্রত্যাশিত কোনো বিশেষ নিষেধাজ্ঞা বা বিশেষ কোনো আদর্শমান স্থাপন, Non-Tariff Barriers ইত্যাদি বাজার প্রবেশগম্যতায় অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে দেয়। সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ কারণে Single Source Selection দেখতে পাওয়া যায়। তবে PPR-2008 অনুযায়ী এ ধরনের বিশেষ ক্ষেত্রে বলতে কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা কোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলার সময় বোঝানো হয়েছে। ক্রয় বিধিমালার এ বিষয়গুলো প্রতিপালন করলে PPA-2006 এবং PPR-2008-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা আইনের কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই। তবে আমাদের দেশে Mergers and Acquisitions সংক্রান্ত বিধি-বিধান সহজ হওয়ার ফলে অনেক Multi-National Companies (MNCs) তথ্য গোপন করে জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দেয়।

আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে এ ধরনের অনেক ঘটনাই ঘটেছে। প্রতিযোগিতা কমিশন প্রতিষ্ঠার পর এ ধরনের যোগসাজশের ঘটনা কমে এসেছে। MNCs জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশনকে শর্তারোপ করার পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা এ শর্তারোপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসাবে গণ্য হয়। আবার বৈদেশিক বিনিয়োগকে (FDI) প্রতিযোগিতার জন্য সব ক্ষেত্রে সহযোগী ভাবাও ঠিক নয়। তবে এটি দেখতে হবে যে, বাজারে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা কর্তৃত্বময় অবস্থানে চলে যাবে কিনা। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব, (4iR)-এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে বিশেষায়িত জ্ঞান ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে। Neoclassical Economists-দের মতে, বর্তমান মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির জন্য ভৌত অবকাঠামো, সহজ মূলধন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রা, ব্যাস্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, গভর্ন্যান্স, উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা, চাহিদা, বিপন্ন ও বাজারের পরিধি ইত্যাদি বিষয়গুলো খুবই জরুরি। আর টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মুক্ত প্রতিযোগিতা একটি নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে একটি বাজার তার মানবসম্পদ, মূলধন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে কী পরিমাণ উৎপান বৃদ্ধি করল, তাও বিবেচনায় নিতে হয়।

প্রতিযোগিতামূলক বাজার কেবল ভোক্তাদের সুফল লাভের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে না; বরং এটি দেশের অর্থনীতিতে একটি নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে দুর্নীতি কমানোর সুযোগ সৃষ্টি করে। বাজারে প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য চাই পলিসি মেকার, শিক্ষাবিদ, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া, ভোক্তা, উদ্যোক্তা, ক্রেতা-বিক্রেতার সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা।